তারা বলছেন, অনেক কোভিড-১৯ রোগী আছে যাদের দেশে পরীক্ষার সক্ষমতার অভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তাদের অবাধ চলাফেরার কারণে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, যা একই সাথে ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরকারের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে পারে।
সোমবার সরকার রমজান মাস এবং আসন্ন ঈদুল ফিতরের মুসলমানদের বৃহত্তম উৎসবকে বিবেচনা করে সীমিত আকারে ১০ মে থেকে শপিংমল এবং অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করার অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও সরকার কিছু শর্ত আরোপ করেছে যে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, মল এবং দোকানগুলোতে প্রবেশের সময় স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা অনুসরণ করা এবং নিয়মিতভাবে বাজারে আগত পরিবহনকে জীবাণুমুক্ত করা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে সেনাবাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তীক্ষ্ণ নজর না থাকলে এটা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। তারা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে দোকান এবং শপিংমলগুলোতে না গিয়ে, লোকদের ঈদ শপিংয়ের জন্য অনলাইন বেছে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানীর দুটি বৃহত্তম শপিংমল বসুন্ধরা সিটি এবং যমুনা ফিউচার পার্ক কর্তৃপক্ষ করোনা পরিস্থিতে শপিংমল না খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনাভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করা একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
‘আমরা এমন সময়ে শপিংমলগুলো আবার খুলতে যাচ্ছি যখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পুরো দমে চলছে এবং সংক্রমিত অধিকাংশ লোক পর্যাপ্ত পরীক্ষার সক্ষমতা না থাকার কারণে শনাক্ত করা যায়নি। মানুষ যখন ঈদের আগে কোনো শপিংয়ে যাবে তখন আমরা এটি করছি। সুতরাং, এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।’
যদিও লকডাউন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায়নি তারপরও এটি করোনার সংক্রমণকে ধীরে ধীরে কমাতে সহায়তা করেছে বলে তিনি মনে করেন।
‘আমরা যখন পোশাক কারখানা এবং ইফতার বিক্রির জন্য রেস্তোরাঁগুলো পুনরায় চালু করলাম তখন লকডাউনটি শিথিল হয়ে গেছে এবং লোকেরা এখানে সেখানে ঘুরতে শুরু করেছে। যদি আমরা শপিংমলগুলো আবার খুলি তবে জনসাধারণের চলাচলের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং ফলে তখন আমরা করোনাভাইরাস পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব।’
যেহেতু ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, ফলে নির্বিঘ্নে তারা সর্বত্র চলাফেরা করবে এবং ভাইরাসটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেন, সংক্রমিত লোকেরা যদি বাজারগুলোতে ভিড় করে এবং বিক্রয়কেন্দ্র/ বিক্রয়কর্মী হিসেবে দোকানগুলেতে কাজ করে তবে তারা ভাইরাস সংক্রমণে ‘সুপার স্প্রেডার’ হয়ে উঠবে।
তিনি পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে, দোকান মালিকদের এবং বাজার কর্তৃপক্ষকে ভাইরাস সংক্রমণকে সীমাবদ্ধ রাখতে সকল সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
‘আমি এখনও সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, মে মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই লকডাউনটি কার্যকর রাখা উচিত। আমরা লোকজনকে অনলাইন শপিংয়ের উপর নির্ভর করতে পরামর্শ দিচ্ছি।’
করোনার পরিস্থিতি যাচাই করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত আট সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকার অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে দোকান ও মার্কেট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বাড়িয়ে তুলতে এর ঝুঁকি রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
‘সরকার ভাইরাস সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে কিছু গাইডলাইন দিয়েছে। আমরা যদি সেগুলো সঠিকভাবে এবং ধর্মীয়ভাবে বজায় রাখতে পারি তবে শপিংমলগুলো পুনরায় চালু হওয়ার কারণে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খুব কম প্রভাব ফেলবে ।’
বিশেষজ্ঞরা ক্রেতা ও বিক্রেতার মাস্ক ব্যবহারের নিশ্চিতকরণ, সামাজিক দূরত্ব, সাবান এবং পানিতে ঘন ঘন হাত ধোয়া নিশ্চিত করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। ‘মাস্ক ছাড়া কাউকেই কোনো মার্কেটে প্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত নয়।’
তিনি বলেন, সরকারের সকল নির্দেশনা বজায় রেখে নিরাপদ ঈদ শপিং নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মার্কেট জোরদারভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। ‘যদি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মার্কেটের নির্দেশিকাগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় তবে আমি মনে করি এটি আরও ভালো কাজ করবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ভ্যাকসিন ও ওষুধ না থাকায় করোনাকে মোকাবিলার একমাত্র বিকল্প হলো প্রতিরোধ করা। ‘আমরা যদি লকডাউন তুলি এবং সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি বজায় না রাখি তবে আমরা ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে করোনাভাইরাস এবং আক্রান্তের সংখ্যা এখন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে এটিও সত্য।
‘সরকার ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ক্রেতার স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করে আমরা ভাইরাসের প্রকোপটি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারি। সুতরাং, সকল ক্রেতা, বিক্রেতা এবং বাজার কর্তৃপক্ষকে ভাইরাস প্রতিরোধে নির্দেশনা মেনে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।’
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, মনে হচ্ছে ইম্যিউনিটি কনসেপ্ট ধারণা গ্রহণ করে সরকার লকডাউনটি শিথিল করছে।
তিনি বলেন, ‘এটি মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর জন্য নিয়তির উপর নির্ভর করার একটি উপায়। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ একবার সংক্রমিত হয়ে যায় (৫০ শতাংশের বেশি), তবে এটি বাকিদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।’
ডা. হারুন বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলের জন্য সরকারের উচিত হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখা, কারণ আগামী সপ্তাহগুলোতে লকডাউন শিথিল করার কারণে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে।